নিজেকে ‘ওপেন ওয়াটারম্যান’ হিসেবে ঘোষণা করতে চাই : সাগর

৩৭ বছর পর বাংলাদেশের দুই সাঁতারু মাহফিজুর রহমান সাগর ও নাজমুল হক হিমেল বিখ্যাত ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়েছেন। ৬ জনের রিলে দল ১২ ঘণ্টা ১৫ মিনিট সময়ে ইংল্যান্ড থেকে ফ্রান্স প্রান্ত স্পর্শ করেছে।

ঐতিহাসিক ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার নানা ঘটনা ইংল্যান্ড থেকে ঢাকা পোস্টের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আরাফাত জোবায়েরকে জানিয়েছেন বাংলাদেশের সাবেক তারকা সাঁতারু ও অলিম্পিয়ান মাহফিজুর রহমান সাগর। 

ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি প্রায় সব সাঁতারুর স্বপ্ন। আপনার এই স্বপ্ন পূরণের অনুভূতি কেমন?

সাগর : একেবারে ছোটবেলা থেকে ব্রজেন দাসের ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার গল্প পড়েছি ও শুনেছি। যখন সাঁতারু হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করি তখন আরেক কিংবদন্তী সাঁতারু মোশাররফ হোসেন খানের ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার বিষয়টি জেনেছি। আমার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করব। সেটা অবশেষে করতে পেরেছি। একজন মানুষ যখন দীর্ঘদিন থেকে একটি স্বপ্ন লালন করে, সেটা বাস্তবায়ন হলে অনুভূতির ভাষা থাকে না। আমারও অনেকটা তাই। 

ব্রজেন দাস, মোশাররফ হোসেন খান দুই জনই একা পাড়ি দিয়েছিলেন। আপনি রিলে দলের অংশ হয়ে। 

সাগর : আমারও ইচ্ছে ছিল একাই পাড়ি দেওয়ার। একা পাড়ি দিতে ২০-২৫ লাখ টাকা ব্যয় হয়। আমার পক্ষে সেই টাকা বহন করা সম্ভব নয় আবার পৃষ্ঠপোষকতাও পাওয়া যায় না। তাই রিলেতে অংশগ্রহণ করেছি। যাতে ব্যয়টা কম ও বহনযোগ্য হয়। বাংলাদেশ বিমান ছাড়া তেমন আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা পাইনি আমরা। এরপরও আমার একা পাড়ি দেওয়ার ইচ্ছে রয়েছে। সেভাবে আরও প্রস্তুতি নেব। 

ফ্রান্সের উপকূলে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল আমি পেরেছি, আমরা পেরেছি : সাঁতার শেষে নিজের ফেসবুকে এভাবেই অনুভূতি জানান সাগর। 

আপনি ও নাজমুল হক হিমেলের পাশাপাশি ভারতের দুই সাঁতারুর অংশ নেওয়ার ছিল। গতকাল জানতে পারলাম চার জনের পরিবর্তে রিলে দল ছয় জনের এবং সেখানে এক মেক্সিকানও রয়েছে। 

সাগর: হ্যাঁ, প্রাথমিকভাবে আমরা চার জনই ছিলাম। ভারতীয় এক সাঁতারু তার চাকরি সংক্রান্ত কারণে অংশ নিতে পারেননি। তখন আমরা আরো রিলে পার্টনার খুঁজছিলাম। সেই সময় একজন মেক্সিকানও ছিল। তাকে অনুরোধ করি, সে রাজি হয়। সব মিলিয়ে ছয় জনের হয়েছে। ছয় জন হওয়াতে সবারই একটু পরিশ্রম কম হয়েছে। সবাই এক ঘণ্টা করে দুই বার দুই ঘণ্টা সাতরেছে। চার জন হলে সেটা তিন ঘণ্টা হতো। পুলের সাঁতার রিলের মতো এখানেও এক ঘণ্টা সাঁতারের পর টিমমেটকে স্পর্শ করলে সে নেমেছে। ৫ জন দুই ঘণ্টা সাঁতরেছে আমি মিনিট পনেরো বেশি। একা পাড়ি দিতে ২০-২৫ লাখ টাকা ব্যয় হয়। আমার পক্ষে সেই টাকা বহন করা সম্ভব নয় আবার পৃষ্ঠপোষকতাও পাওয়া যায় না। তাই রিলেতে অংশগ্রহণ করেছি। যাতে ব্যয়টা কম ও বহনযোগ্য হয়। বাংলাদেশ বিমান ছাড়া তেমন আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা পাইনি আমরা। এরপরও আমার একা পাড়ি দেওয়ার ইচ্ছে রয়েছে। সেভাবে আরও প্রস্তুতি নেব। সাঁতারু মাহফিজুর রহমান সাগর

রাত আড়াইটায় আটলান্টিকে নামলেন। এত গভীর রাতে সাঁতার করা কতটা কঠিন ছিল?

সাগর: আসলে আমরা খুব মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলাম। বারবার আমাদের স্লট পরিবর্তন হচ্ছিল। এমনও হয়েছে আমরা হোটেল থেকে রওনা হয়েছি এমন সময় জানানো হয়েছে আজ বৈরী আবহাওয়ার জন্য করা যাবে না। এ রকম কয়েক বার হয়েছে। এতে আমরা এতটাই বিষন্ন ছিলাম। এমনও শঙ্কা ভর করছিল, আসলে এবার সাঁতারের সুযোগ পাব তো নাকি না করেই দেশে ফিরতে হবে। আবার যারা রিলে দলে ছিল তাদেরও ব্যস্ততা ছিল। তাই সবারই লক্ষ্য ছিল যখনই সুযোগ পাব, তখনই করব। রাত আড়াইটা হলেও আমাদের কাছে সেই রকম অনুভূতি ছিল না। রাত হওয়ায় ভিজিবিলিটি (দৃশ্যতা) একটু সমস্যা ছিল। আবার ঠান্ডাও ছিল।

আপনি প্রথমে নেমেছেন এরপর রিলে দলের অন্য পাঁচ জন করেছেন। তারপর আবার আপনি এক ঘণ্টা সাঁতরেছেন আবার পাঁচজন পাঁচ ঘণ্টা। বোটের দশ ঘণ্টা সময় কিভাবে কেটেছে?

সাগর: সী সিকনেস হয়েছিল। আমি এক ঘণ্টা করার পর যখন বোটে উঠি বমি করেছিলাম। পাঁচ জন এক ঘণ্টা করে করায় পাঁচ ঘণ্টা সময় ছিল। ফলে স্বাভাবিক হওয়ার সময় ছিল। গভীর রাত থেকে দুপুর হয়েছে শেষ করতে। সবার মধ্যেই উন্মাদনা ছিল। ফলে সময় কখন পেরিয়ে গেছে কেউ বলতে পারেনি। 

ইংলিশ চ্যানেল মূলত ইংল্যান্ড থেকে ফ্রান্সে পাড়ি দেওয়া। যখন ফ্রান্স প্রান্ত স্পর্শ হলো তখন আপনাদের অনুভূতি?

সাগর: ফ্রান্স প্রান্ত স্পর্শ করার পর জাজ সঙ্কেত প্রকাশ করেন। এটার মাধ্যমে সফল পাড়ি সমাপ্ত হয়। নির্ঘুম রাত, ১২ ঘণ্টার সাঁতার সবাই অনেক ক্লান্ত হলেও তৃপ্তি কাজ করছিল। ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়ায় আমাদের নাম থাকবে এটা ভেবে অসাধারণ প্রশান্তি লাগছিল।

এত অর্থ ব্যয়, প্রস্তুতির পরও অনেকে ডিসকোয়ালিফাইড হয়। পাড়ি দেওয়ার সময় আপনাদের সেই শঙ্কা কাজ করছিল না? 

সাগর: ডিসকোয়ালিফাইড নিয়ে সাঁতারের আগে খুব ভাবতাম। আটলান্টিকে নামার পর আমরা সবাই সাঁতার ও নিজেদের শরীর নিয়ে ফোকাস ছিলাম। নভেম্বরে আনুষ্ঠানিক সনদ পাব। আমরা সফলভাবে শেষ করেছি জাজরা জানিয়েছেন এবং ইংলিশ চ্যানেলের ওয়েবসাইটেও এটার স্বীকৃতি আসবে শীঘ্রই। 

সাধারণ সাঁতার প্রতিযোগিতার চেয়ে এটা কতটা ভিন্নতা এবং চ্যালেঞ্জিং ছিল?

সাগর: ওপেন ওয়াটার আর পুলের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। সাধারণ সাঁতার প্রতিযোগিতাগুলো খুবই স্বল্প সময়ের। আর এখানে দীর্ঘ সময় সাঁতরাতে হয়। প্রতিকূল পরিবেশ; ঠান্ডা ও মধ্যরাত। লম্বা সময় এবং প্রতিকূল পরিস্থিতির জন্যই ইংলিশ চ্যানেলের বিশেষত্ব। দীর্ঘদিন পুলে সাঁতার করেছি, এখন নিজেকে ‘ওপেন ওয়াটারম্যান’ হিসেবে ঘোষণা করতে চাই। সাঁতারের মাধ্যমে আমার পক্ষে যতটুকু দেশের সম্মান বৃদ্ধি করা যায় সেই চেষ্টাই করেছি সময়। ফুটবল, ক্রিকেট নিয়ে যতটা আলোচনা অন্য খেলাতেও অনেক অর্জন কৃতিত্ত্ব রয়েছে সেগুলো স্বীকৃতি পাওয়া উচিত। না হলে ক্রীড়াবিদরা এক পর্যায়ে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে।মাহফিজুর রহমান সাগর

৩৭ বছর পর বাংলাদেশের দুই সাঁতারু ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়েছে। এটা বাংলাদেশের বিশেষ ঘটনা। ক্রীড়াঙ্গন তো বটেই জাতীয় পর্যায়ে আলোচনা হওয়ার মতো বিষয় কিন্তু সেই রকম কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। এটা ভাবলে আফসোস লাগে কি না… 

সাগর: আসলে এগুলো নিয়ে ভাবলে তো আর সাঁতারই করতে পারতাম না। সাঁতারের মাধ্যমে আমার পক্ষে যতটুকু দেশের সম্মান বৃদ্ধি করা যায় সেই চেষ্টাই করেছি সময়। ফুটবল, ক্রিকেট নিয়ে যতটা আলোচনা অন্য খেলাতেও অনেক অর্জন কৃতিত্ত্ব রয়েছে সেগুলো স্বীকৃতি পাওয়া উচিত। না হলে ক্রীড়াবিদরা এক পর্যায়ে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে।

২০১২ সালে লন্ডন অলিম্পিকে বাংলাদেশের পতাকা বহন করেছেন। ২০১৬ সালে রিও অলিম্পিকেও খেলেছেন। এবার ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিলেন। কোন মুহূর্তটা বেশি স্মরণীয়? 

সাগর: একজন অ্যাথলেটের স্বপ্ন থাকে অলিম্পিকে খেলা আবার অনেক সাঁতারুদের কাছে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়া অলিম্পিকের সমানই। তবে আমার কাছে অলিম্পিকে বাংলাদেশের হয়ে অংশগ্রহণই সবচেয়ে বেশি স্মরণীয়। অলিম্পিক বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়া ইভেন্ট। সেখানে দেশের পতাকা বহনের চেয়ে একজন ক্রীড়াবিদের সম্মান আর কি হতে পারে।

৬ জনের রিলে দলে আপনি একমাত্র অলিম্পিয়ান। এটা তাদের অনুপ্রাণিত করেছে নিশ্চয়ই…

সাগর: আসলে আমাদের দেশে অলিম্পিয়ানদের নিয়ে সেই রকম আলোচনা হয় না। তবে এখানে এসে যখন অনেকেই শুনেছে দু’টি অলিম্পিকে অংশ নিয়েছি। তখন সবাই অনেক সম্মান করেছে। অনেকে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ নিয়েছে। তখন নিজেকে একজন অলিম্পিয়ান হিসেবে অনেক গর্বিত মনে হয়েছে।

আপনি দুই অলিম্পিকে অংশগ্রহণ, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অসংখ্য পদকের পর ইংলিশ চ্যানেল পাড়িও দিলেন। বাংলাদেশের সাঁতার বলতে ব্রজেন দাস ও মোশাররফ হোসেন খানের নাম আসে। তাদের পর এখন আপনার অবস্থান দেখেন কি না…

সাগর: কখনোই না। তারা কিংবদন্তি। মোশাররফ হোসেন খান এক সাফ গেমসে পাঁচটি স্বর্ণ জিতেছে। দেশেও তার অসংখ্য কীর্তি। আমি কখনোই তার সঙ্গে তুলনায় যাব না। আমি, শিলাসহ আরো অনেকে যার যার ইভেন্ট ও সময়ের সেরা। 

আপনার মন্তব্য

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Space for ad

অনুসরন করুন

সর্বশেষ খবর

স্বত্ব © ২০২৫ চ্যানেল এইচ নিউজ

Design & Developed : Rose IT BD